এস এম সামছুর রহমান, বাগেরহাট প্রতিনিধি:
বাগেরহাটে জনপ্রিয়তা বাড়ছে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের। পোড়া মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন নির্মাণ কাজে এসব কংক্রিট ব্লক ব্যবহার হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলার বিভিন্ন স্থাপনা নির্মান করা হয়েছে এসব পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক দিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে, পাঁচটি বাড়ি, একটি লাইব্রেরি ভবন, শিক্ষার্থীদের জন্য বাথরুম ও ৮৫০ মিটার রাস্তা। আর কংক্রিট ব্লকের চাহিদা থাকায় জেলায় অন্তত ২৫/৩০ টি ছোট বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। আরো অনেকে ইতিমধ্যে এই কারখানা স্থাপনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন। যার ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে বেকার যুবকদের।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে, মোটা বালু, সিমেন্ট ও পানি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় অথবা আধা স্বয়ংক্রিয় মেশিনে সাইজ ও আকার অনুযায়ী ব্লক তৈরি করা হয়। ব্লকটির মাঝখানে ফাঁকা থাকায় ভবনের ওজন কম হয়, গাঁথুনি অনেক দ্রুত হয়, পলেস্তারা ও শ্রমিকের ব্যয় কম হয়। ব্লক দিয়ে তৈরি দেয়ালে ছত্রাক, শেওলা ও লবণ লাগার ঝুঁকি কম থাকে। পাঁচটি ইটের আকৃতির অর্থাৎ ১২৮ বর্গ ইঞ্চির একেকটি ব্লক তৈরিতে ব্যয় হয় ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এ ব্লক ব্যবহারে ইটভাটায় কৃষিজমির মাটির ব্যবহার কমছে। সেই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার খান জাহান আলী ডিগ্রি কলেজে একটি লাইব্রেরী ও ফকিরহাট উপজেলায় একটি মসজিদ মডেল স্থাপনা হিসাবে তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে এলাকার অনেকেই এখন ছোট বড় বিভিন্ন স্থাপনায় আস্থার সাথে করছেন ব্যবহার করছেন।
খানজাহান আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ খন্দকার আসিব উদ্দীন রাখি জানান, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিৎ। কেউ পরিবেশের ক্ষতি করলে এর প্রভাব থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাবো না। পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের সাহায্যে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিট খান জাহান আলী ডিগ্রি কলেজে একটি লাইব্রেরী স্থাপন করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই লাইব্রেরী দেখতে অনেক লোক আসছেন। তারা পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তাছাড়া কিছুদিন আগে কলেজ মাঠে পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সমগ্রীর মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই মেলায় বাগেরহাটসহ পাশ^বর্তি জেলার লোকজনও এসেছে। তারা এই পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি স্থাপনায় শতভাগ ব্লক ইট ব্যবহার করতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনাও দিয়েছেন। সরকার প্রধানের নির্দেশনায় কংক্রিটের ব্লক ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) “সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট”(এসইপি)। বেসরকারি সংস্থা কমিনিউটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) প্রকল্পটি বাগেরহাটসহ কয়েকটি জেলায় বাস্তবায়ন করছে।
কোডেক থেকে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন বাগেরহাট জেলার আবু সাইদ, মারুফ হোসেন, এরশাদ শেখ, হাফিজুর রহমান, তুষার পাল ও জাহিদুল ইসলামসহ অনেকে। এ পর্যন্ত ২৫ জন উদ্যোক্তা পন্য উৎপাদন ও বিক্রয় করছেন এবং ৪০ জন উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নিয়ে মেশিন ক্রয়ের অপেক্ষায় আছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে মেশিন কিনে ব্লক তৈরি করে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেছেন বাগেরহাট পৌরসভার সোনাতলা এলাকায় উদ্যোক্তা আবু সাইদ। তিনি বলেন, আমার কারখানায় এখন ১৫ জন শ্রমিক কাজ করে। নিজের বাড়ির পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী অনেক লোকের বাড়িতে ব্লক সরবরাহের চুক্তি করেছি। ব্লকের যেমন ব্যয় কম, লাভও ভালো। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় অনেকেই এখন ব্লক দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করতে চান।
রাজমিস্ত্রি মাহবুব আলম বলেন, আমি নিজেই ব্লক তৈরি করি। এলাকায় কেউ ব্লক দিয়ে বাড়ি করতে চাইলে, তাকে বাড়ি বানিয়ে দিই। আমার সঙ্গে অন্য দক্ষ শ্রমিকরাও থাকেন। ব্লক দিয়ে তৈরি বাড়িতে যেমন টাকা সাশ্রয় হয়, সেই সঙ্গে শীত—গরমেও আরামে থাকা যায়।
এসইপি প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক লোকমান হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরেই সরকার চাচ্ছে নির্মাণ কাজে পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার কমে আসুক। এজন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের উদ্যোক্তারা কংক্রিটের ব্লক তৈরি এবং বাজারজাত করছেন। নতুন নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এ পর্যন্ত আমরা ব্লকের উদ্যোক্তা তৈরি ও সচেতনা বৃদ্ধির জন্য দুই শতাধিক মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সচেতনামূলক প্রচার প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
পিকেএসএফ‘র এসইপি প্রকল্পের পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী উপ—প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: মশিউর রহমান মিশু শাহ বলেন, ইটের বিকল্প এবং ব্যয়সাশ্রয়ী নির্মাণ উপকরণ সিমেন্টের ব্লক নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছে বাংলাদেশ হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার যেমন পরিবেশবান্ধব তেমন ব্যয় সাশ্রয়ী। এছাড়া কংক্রিট ব্লক তৈরির মাধ্যমে ফসলী জমি রক্ষা পাচ্ছে ও বায়ু দূষণ হ্রাস পাচ্ছে। ইটের বিকল্প হিসেবে এর ব্যবহারে মানুষের মধ্যে আগ্রহও বাড়ছে।
কোডেকের পরিচালক স্থপতি কাজী ওয়াফিক আলম বলেন, যারা প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ—বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে স্থাপনা তৈরি করবেন, কোডেক তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে। কোডেকের উদ্যোগে কংক্রিটের ব্লক, পার্কিং টাইলস নির্মাণে দক্ষ শ্রমিক ও উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় নাগরিকদের সচেতন করতে সভা সেমিনার, লিফলেট, পোস্টার বিতরণসহ বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া কোডেক ও প্রকল্পের যৌথ অর্থায়নে মডেল স্থাপনা হিসেবে বাগেরহাট খানজাহান আলী ডিগ্রী কলেজে ব্লক দিয়ে ৭২০ বর্গফুটের একটি পাঠাগার নির্মাণ করা হয়েছে।
বাগেরহাট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরীফুজ্জামান বলেন, পোড়া ইটের থেকে কংক্রিট ব্লক অনেক বেশি কার্যকর, ব্যয় সাশ্রয়ী, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। এ কারণে অনেক গ্রামীণ সড়ক ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। দিন দিন এ ব্লকের ব্যবহার বাড়ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।